যাপনে জীবনের প্রভাব


একের পর এক শব্দ লিখছি আর কাঁটছি, কিন্তু কোনো পূর্ণ বাক্যই গঠন করতে পারিনি যা আমার লেখায় শব্দ ছন্দের ণৃত্যে আশ্চর্য কিছু বোধ জাগাবে যা লেখকের মনের ভাবের অনেকটা কাছাকাছি যা সৃজনশীল চিন্তায় শৈল্পিক বিকাশ ঘটাবে, লেখার মতো অনেক বিষয় থাকে, অনেক গল্প থাকে, থাকে অনেক বাক্য, ছন্দ, লয় আর ভাষা, এগুলিই মূলত একটা লেখার প্রাণ, হোক সেটা প্রবন্দ, গল্প, কবিতা, রচনা কিংবা মতবাদ।


#খ্যাতির_বিড়ম্বনা

একটি লেখা পুনর্জন্ম দেয় লেখককে শতাব্দীর শেষ লগ্নেও তার পাঠকের মনে, তা যেমন সত্য তেমনই সত্য, সময়ের ব্যবধানে সামাজিক ন্যায়নীতি সংক্রান্ত সামাজিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধের মধ্যেও বিশাল ব্যবধান তৈরী করে দেয় ঐতিহাসিকের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, যে কারণে কার্ল মার্কস যিনি মার্কসবাদের জনক, তিনি সারা বিশ্বের বামপন্থীদের কাছে দেবতাতুল্য হলেও নিজের জন্মস্থান আর্জেন্টিনায় আর্জেন্টাইন নাগরিকদের কাছে কুখ্যাত ও নিন্দিত ব্যক্তি হয়ে আছেন এই কারণে যে তিনি সমকামীদের হত্যা করেছিলেন।


আর বাংলাদেশে যারা কট্টর ধার্মিক বা বামপন্থীদের নাস্তিক বলতেও দ্বিধা করেন না তাঁরা কিন্ত মার্কসএর সমকামীদের হত্যা করাকে সমর্থন করেন যদিও তাঁরা জানেন না এবং জানতে আগ্রহীও নন কোন কারণে মার্কস্ সমকামীদের হত্যা করেছিলেন, ইসলামে সমকামিতা হারাম এবং শুধু এই একটা কারণেই ইসলামিক দেশগুলোতে তরুণ প্রজন্মের কাছে মার্কসবাদকে লুকানো হয় না বরং মার্কস যেন হুট করেই জন্মও নিয়েছিলেন এ বাংলায় সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ শিকদার নামে যিনি বিশেষ করে মাওবাদী কমরেড ছিলেন , মাওবাদীদের উগ্র পন্থাকে জঙ্গিবাদ বলে নিষিদ্ধ করে রাখে প্রায় সকল দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রই, কিন্তু মাওবাদই চীনের শিল্প বিপ্লবে প্রাথমিক ভূমিকা রেখেছিল।


অপর দিকে সক্রেটিস হাটে মাঠে ঘাটে জনস্বাধারণ ও তরুণদের ডেকে জড় করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন, সহজ প্রশ্ন, এর উত্তরও সহজ শুধু একটু ভেবে নিলেই হয়, এই প্রশ্ন-উত্তর, যুক্তি-তর্কের খেলায় জট খুলে যেত অনেক জটিল বিষয়ের, জন্ম নিত ন্যায় নীতির গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, দর্শনের বহুবিধ দৃষ্টি, রাষ্ট্রের জটিল সব সমস্যার সমাধান, আইনে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুফল এবং সক্রেটিসের জ্ঞ্যানের আলো এতোই তীব্র ছিল 'ছেলে বুড়ো সব দল বেঁধে সক্রেটিসের কাছে যেতেন মুক্ত চিন্তায় যুক্ত হয়ে বুদ্ধির নখে শান দিতে।'

তাঁর এই সমস্ত কারণে দর্শনে অমর কৃতিত্ব রেখে যেতে পেরেছেন তিনি, কিন্ত তেমন একই কাজ বর্তমান সময়ে করাটা পাগলামি বৈকি আর কিছুর স্বাক্ষ দিবে না, এর একটা উদাহরণ হচ্ছে মসজিদে মসজিদে ঘুরে বেড়ানো তাবলিগদের একটি দল যারা হাটে মাঠে বাজারে জনস্বাধারণদের ডেকে ধর্মের বানি শুনাতে শুনাতে একটা মুহুর্তে মসজিদে নামাজের জন্য টানাটানি শুরু করেন, অনেকে তাদের দাওয়াত গ্রহণ করেন এবং বেশিরভাগ মানুষই যথেষ্ট বিব্রত ও বিরক্ত হোন,  তাবলিগের এই কাজটাকে যথেষ্টই অপছন্দও করেন, কিন্তু তাবলিগের এমন প্রথাগত আচরণ পুণ্যের হলেও  সময় আর সংস্কৃতির ব্যবধানে একই কাজ যা করেছিলেন পশ্চিমে আড়াই হাজার বছর আগে সক্রেটিস আর বাংলাদেশে এই যুগে তা করেছেন তাবলিগের হাজার হাজার দল তফাৎ কেবল সময় আর সংস্কৃতির, আদর্শগত জায়গা থেকে দুটো দর্শনই যেন শ্বাসত, অনন্ত ও ঐশ্বরিক জ্ঞ্যান সমৃদ্ধ, জগত খ্যাত অনেক ব্যক্তিত্বরাই সময়ের ব্যবধানে খ্যাতির বিড়ম্বনায় পড়েছেন এভাবেই।



#শক্তির_সঞ্চরণ

একটি লেখায় লুকিয়ে থাকেন লেখক স্বয়ং এবং তার চিন্তা, রুচি, যাপনের অবস্থা, জীবনের প্রতি দৃষ্টি, বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা, শব্দের চয়ন ও ব্যবহার, বাক্যের প্রতিটি গঠনে যেন লুকিয়ে থাকেন লেখকের একেকটি মেজাজের আমেজ যা পাঠককে হিপনোটাইজ করার মতো আঁকড়ে রাখে পাঠ্যে, জাদুকরী গল্পজালে বন্দি করে জ্ঞ্যানের পথ দেখান লেখক, একটি লেখায় কেবল জ্ঞ্যানই থাকে না, থাকে শিল্পগুন, প্রাণবন্ততা, প্রাঞ্জলতা, ছন্দ, তাল, গল্প ও জীবন।


একটি লেখা-ই যেন একটি ভাষ্কর্য যা হাজারটা দৃষ্টি, চিন্তা ও পরিকল্পনার জন্ম দেয়, দেয় একটা মৌলিক প্রাণের অস্তিত্বও যেমনটা লেখক চাচ্ছেন আবার একই লেখা একটি শিল্পও যা প্রকৃত কোনো অর্থ বহন করে না বরং এতে আছে একই ভাবের বিশেষ মাত্রা যেমনটা আমরা সুরের রাগে খুঁজে পাই, যে রাগ ভাবেরই উচ্চ মার্গের প্রকাশ যে ভাব বিভিন্ন সুরকার বিভিন্ন গানে প্রকাশ ঘটান, শিল্পও বিশেষ কোনো অর্থ বহনে বাধ্য নয়, বাধ্য বরং রাগের একটা মাত্রা বহনে, যে রাগের মাত্রা সমার্থক শক্তি যোগাবে দ্রষ্টার কল্পনার দৃশ্যপটে, ঠিক তেমনই একটি লেখা যা বিশেষ অর্থ বহন করে না, বহন করে কিছু আত্মাদের, কিছু শক্তির, কিছু ব্যক্তিত্বের এবং এগুলি একত্রে আমরা আরোহন করি জ্ঞ্যান বলে।


#জ্ঞ্যান_বিভাজন

কোন জ্ঞ্যান কে কিভাবে কাজে লাগাবেন তা ব্যক্তির একক ইচ্ছায় আবৃত, সব জ্ঞ্যান সবাইকে একই পথে পরিচালনা করে না, জ্ঞ্যান শুধু মাত্র বুদ্ধির গোঁড়ার খুঁটি শক্ত করে বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত, উদাহরণ এবং পরিনতি সংক্রান্ত পাঠ্য দানে আর এগুলি পুঁজি করে কেউবা রাষ্ট্রের খুঁটি মজবুদ করে আবার কেউবা নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনের বীজ বপন করে জনমনে, কেউ হচ্ছেন নন্দিত কেউবা হচ্ছেন নিন্দিত, খ্যাতির বিড়ম্বনায় সবাই পড়ছেন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ।


আমি যা লিখছি তা আমি নই, কেবলই তা আমার ক্ষণিকের ভাবনা মাত্র, প্রবন্দে আমার প্রকাশ নেই, আমি এখন যা ভাবছি বা লিখছি একটু পর বিপরীতমুখী ভাবনাও ভাবতে পারি, কোনো ভাবনাই শ্বাসত নয় বরং প্রত্যেকেই যার যার দিক থেকে স্বতন্ত্র।


#পরিবার_প্রথা 

আমাদের একজন বিজ্ঞানী আছেন "জামাল নজরুল ইসলাম স্যার" যিনি জগত খ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর সহপাঠী, বন্ধু এবং রুমমেটও ছিলেন, জামাল নজরুল ইসলাম একটি বই লিখেছিলেন "দ্যা আল্টিমেট ফেইট অফ দ্যা ইউনিভার্স "  নামে ১৯৮৩ সালে  এবং ১৯৮৮ সালে মানে ৫ বছর পর স্টিফেন লিখেন "এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম" যা স্টিফেনকে জগত বিখ্যাত করেছে।

নজরুল ইসলাম স্যারের বড় মেয়ের বিয়েতে স্কটল্যান্ডের একজন বিজ্ঞানী ছিলেন স্যারের বাসায়, তখন ওনার ছোট মেয়ে তার বান্ধবীদের সাথে হারমনি নিয়ে গান রচনা করছে,  হাসি ঠাট্টা করছে যে দৃশ্যটা খুব গভীর ভাবে আবেগাপ্লুত করেছিল স্কটল্যান্ডের বিজ্ঞানীকে এবং তিনি স্যারকে ডেকে বলছেন,

"১০০ বছর আগে আমাদের সংস্কৃতিতে আমাদের সমাজে আমাদের জীবন ধারায় এমন অবস্থা ছিল, একসাথে বসে আমরা গান করতাম, কিন্তু দুঃখের বিষয় এটা আমরা স্থায়ীভাবে হারিয়ে ফেলেছি।"


মুলত, পশ্চিমে আরো ১০০ বছর আগেই হারিয়ে গেছে পরিবার প্রথাটি, এই ভারতীয় উপমহাদেশের পরিবার প্রথা এবং ইসলামিক পারিবারিক আচারে যে ঐতিহ্য এবং সৌহার্দ ফুটে উঠে তা যেন প্রেমেরই নামান্তর, অপর দিকে পশ্চিমে  মুক্ত পুঁজিবাদের অবাধ বিকাশের প্রতি অনুরাগ এবং  টিকে থাকার লড়াই মূলত একটা সময় পারস্পরিক বিশ্বাস, ভরসা বা মায়াময়ি আবেগের মাঝখানে দেয়াল তুলে দেয়, পশ্চিমে কন্টাক্ট মেরেজ নামে এক প্রকার বিবাহ প্রথার বৈধতা আছে যা ইসলামিক রাষ্ট্র গুলোতে সরাসরি হারাম, জাপানেও দেখা যাচ্ছে পরিবারের প্রতি আগ্রহ আবেগ বা মায়া তেমন কিছু ঠিক ততটা নেই যতটা আমরা বাঙালিরা আশা করি, জাপানে বিয়ের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে তরুণদের মাঝে যা জাপান সরকারেরও মাথা ব্যাথার কারণ।


#আত্মোৎসর্গ 

পরিশেষে স্যার নিজের লক্ষ টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে দেশে নিজের পরিবার নিয়ে দেশীয় সংস্কৃতিতে জীবনের শেষ সময়টুকু কাটাবেন বলে চলে এসেছিলেন বাংলাদেশে এবং নিজের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন বাংলাদেশে সর্ব প্রথম মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র তৈরী করে, জামাল নজরুল ইসলাম স্যার কাজ করতেন 'কসমোলজি' নিয়ে যা মহাকাশ বিদ্যার একটা অংশ।


কে কখন কি সিদ্ধান্ত নিবেন তা ব্যক্তি কখনো আগে পরিকল্পনা করে রাখেন না আবার রাখলেও পারিপার্শ্বিক চাপে পরিকল্পনামাফিক সিদ্ধান্তে অটুট থাকতে পারেন না, এ এক অদৃশ্য শক্তিরই যেন প্রভাব যে শক্তির বলয়ে জীবন্ত হয়ে উঠে অস্তিত্ব প্রকাশ করে মন ও আত্মা এবং প্রতিরূপ পায় ভাগ্য, নিয়তি বা কপাল শব্দগুলো।


#ঈশ্বরের_মাত্রা

দার্শনিক বার্কেল এক প্রকার ঈশ্বরকে কল্পনা করতেন যিনি তার অদৃশ্য শক্তির বলয়ে পৃথিবীর সমস্ত কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছেন, প্রথাগত ঈশ্বর নিয়ে কখনো কিছু না বল্লেও তিনি তাঁর দর্শনে একটি ঈশ্বরকে সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন এবং পেরেওছেন, একই রকম ঈশ্বরকে কল্পনা করেছেন ইহুদী লেখক ইউভেল নোয়াহ্ হারারি।

হারারি বলেন "অনেক গুলো মানুষ যখন কোনো বিষয়ের উপর বিশ্বাসে অটুট, তখন তা অবাস্তবও যদি হয় তবুও তা সত্য, শ্বাশত" এবং উদাহরণে হারারী বলেন টাকার প্রতি বিশ্বাসের কথা এবং সামাজিক ভাবে এর ব্যবহারের প্রতি আমাদের আস্থার কথা। 

বার্কেল বলেন ঈশ্বর হচ্ছেন সকল মনের সমষ্টিগত বিশ্বাস, ওদিকে বার্টান্ড রাসেলের কাছে ঈশ্বর হচ্ছেন "প্রকৃত বস্তুর" নামান্তর মাত্র, যার বিশেষ আদর্শগত বৈশিষ্ট্য থাকবে এবং সকলের সমষ্টিগত মনের উপর নির্ভর করবে, যা হারারির ধারণার সাথে অনেকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে হারারি বলছেন , সংখ্যাগরিষ্ঠ মনের বিশ্বাসের উপরই নির্ভর করে কোনটা সত্য, কোনটা পবিত্র বা শ্বাসত।


#আত্মশুদ্ধি 

আমার বোধ গুলো যেন সুন্দরের প্রতি খুব ঋনি, যা দেখি সব যেন ফুটন্ত ফুলের মতো লাগে, প্রেম জাগে, লাগে মায়া, আবেগে আপ্লুত হই যখন সুন্দরকে খুঁজি প্রতিটা প্রাণে, প্রতিটা শিল্পে, প্রতিটা সৃষ্টিতে, প্রতিটা বোধে,  প্রতিটা সুখের কানুনে।

ফুলেরা বনে সুন্দর শিশুরা মায়ের কোলে, সুন্দর একটি সাবুকের প্রথম হাটতে শেখার দৃশ্যটা, সুন্দর একটি অনাহারীর আহার গ্রহণ, সুন্দর একটি শিশুর হাসি মাখা মুখ।

সুন্দরকে আমরা ছুঁতে পাই হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে, বোধ থেকে বিচার করি সুখ আর দুঃখকে, সব সুন্দরই সুন্দর হয় না, চিরাইত কিছু সত্য যা সুন্দর হবার কথা, কিন্তু আমাদের বোধে সুন্দর অনুভূতি জাগায় না, উদাহরণে বলা যেতে পারে প্রেমের তরে একটি ফুলের আত্মবিসর্জনের কথা, কোনো শিশুর হাতের খেলনা হয়ে খেলার ছলে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া ফুলটার ত্যাগের মহমান্বিত একটা মর্মান্তিক গল্প, এগুলি মনে সুন্দর বোধ জাগায় না বরং এগুলিকে পৈশাচিক সুখের উপাদান মনে হয়।



একটা প্রাণ সে যে স্বত্বাধিকারী বা গোত্রীয় হোক, সে প্রাণের অনুভুতি সবারই সমান ,সবাই তার জীবনের পূর্ন স্বাদ পেতে চায়, মৃত্যু অনিবার্য হলেও সেটা স্বাভাবিক ভাবে হওয়াটাই সবার প্রত্যাশা , জীবনের মানেটা সবার কাছেই সমান।

সাম্যবাদের কথা বলছি কিন্তু একটা মুহুর্তে বিবেকের কাঠগড়ায় প্রশ্নবিদ্ব হচ্ছি, " সাম্যবাদীতার সমতা বন্টণে আমি কতটুকু দৃঢ়? " - এই দিক থেকে প্রতিটি প্রাণের প্রতি সমদৃষ্টি আমার দীক্ষিত হবার পথে প্রধান পাথেয় হিসেবে মস্তিষ্ককে আন্দোলিত করছে।

একটি শিশুর মুখের হাসি, একটি ফুলের আগত কলি কিংবা ফলের মুকুল! - সত্যিই এ যেন মধুমাখা সুন্দরের রূপকাশ্রিত পদ, যে সুন্দর দৃষ্টিকে নান্দনিক করে, যে সুন্দর অনুভূতির চর্চা ; প্রাণকে উজ্জীবিত করে - প্রতিটি সুন্দরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগাতে, এ সত্যিই এক আত্ম-উপলব্ধি ও নিজেকে খুঁজে পাবার প্রকৃত পথ।


#সুন্দরের_বীভৎসতা 

এবার প্রশ্নবিদ্ব হচ্ছি নান্দনিক সুন্দরের পরিবেশগত ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে।

পার্কে বসে আছি এক গুচ্ছ গোলাপ নিয়ে প্রেমময়ী প্রেয়সীকে বরণ করে নেব বলে।

বেঞ্চিতে বসে আছি দুজন, আমি বাদামের খোসা ছুলে জমাচ্ছি তার জন্য আর সে আপন মনে উদাসীন বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয় ফুলগুলোর এক এক পাপড়ি ছিড়ে একত্রে জড় করছে, মিষ্টি তার সে হাসি, কত উল্লাস, কত প্রাঞ্জল, কত স্নিগ্ধ সে হাসি।

হঠাৎ আমি চমকে উঠি, আমি দেখি অদ্ভুত বিভৎস দেখা যাচ্ছে তার হাসিটা,  তার হাতে একটি শিশুর মাথা আর সে ছিড়ে ছিড়ে মুখ থেকে মাংস, চামড়া, চোখ, কান খামচে খামচে ছিড়ে নিচ্ছে আর এই ছেড়া মুণ্ডু আমিই এনেছি, প্রেয়সীকে বরণ করে নিতে।

কোনো এক জল্লাদ পথে কাঁটা মুণ্ডু বিক্রি করছে যার থেকে আমি কিনে এনেছি এই মুণ্ডুখানা অতঃপর নিজেকে বুঝাতে শুরু করলাম, এ ভ্রম, যা এনেছি তা কেবলই ফুল। কিন্তু এই ফুলের মুগ্ধকর অনুভুতি, এ কি শুধুই অভিনয় ? যা মুগ্ধ হবার মতো তা কিভাবে ধ্বংস করা যায়? যদি যায় তাহলে এটি কখনো মুগ্ধ হবার বিষয় হতে পারে না।


#শিক্ষা_প্রসঙ্গ 

শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই, শিক্ষা সবার জন্য প্রয়োজন।

শিক্ষায় শিক্ষিত হবো আমি, শিক্ষায় শিক্ষিত হবে আমার বিবেক,  শিক্ষায় শিক্ষিত হবে আমার বোধ,শিক্ষিত হবে আমার আচরণ ও ব্যবহার।

তার সাথে শিক্ষায় শিক্ষিত হবে -আমার ভাই,  বোন, আমার পরিবার, আমার বন্ধু, শিক্ষায় শিক্ষিত হবে পথে ঘুমিয়ে থাকা শিশুটি, তার ছোট বোন বা বড় ভাইটি।


শিক্ষা আমাদের অধিকার সচেতন হতে শেখায়,

শিক্ষা আমাদের প্রকৃতিকে জানতে শেখায়,

শিক্ষা আমাদের বিবেকে নিজের সরূপ বোধ জাগায়,

শিক্ষা আমাদের মানবিক হতে শেখায়।

শিক্ষা আমাদের ইতিহাসের সাক্ষ দেয়,

শিক্ষা আমাদের বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে,

শিক্ষা নন্দন তত্বের কথা বলে।


এই পাঠ্য পড়ার মাঝে আপনারা শিক্ষার্থী আছেন, অভিভাবক আছেন, শিক্ষক সমাজের অনেকেই আছেন।

এদিকে শিক্ষার্থীদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি অথবা পড়াশোনা করার পর কি হবেন?

আপনারা বলবেন কেউবা শিক্ষক-শিক্ষিকা হবেন, সফল উদ্যোক্তা হবেন, সৎ উকিল হবেন কিংবা আদর্শবান ডাক্তার হবেন।

মূলত অর্থনৈতিক মুক্তি কামনায় যখন শিক্ষা গ্রহণ করা হয়, তখন তা একটি জাতির মেরুদণ্ড অপেক্ষা ওই জাতিটার কলঙ্কেরই ধারক বাহক, তার জন্যই শিক্ষা বা পড়াশোনার বিষয়টি শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং বেশ কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছেও গলার কাঁটা হয়ে আছে।

শিক্ষা কোনো পণ্য নয়, শিক্ষা আমাদের অধিকার।

অন্য, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো শিক্ষাও আমাদের মৌলিক অধিকার।

শিক্ষা মূলত আপনার জানতে চাওয়ার পিপাশাটুকু মোটাবে, শিক্ষা মূলত আপনাকে যুক্তির কাঠগড়ায় ন্যায় নীতির সংঘর্ষে প্রশ্নবিদ্ব করাবে সত্য আর সুন্দরের প্রত্যাশায়, শিক্ষা নান্দনিক দৃষ্টি দান করে।

শিক্ষা অনুভূতি জাগ্রত করে প্রত্যাশিত এক সম্ভাবনায়, শিক্ষা ইতিহাস সচেতন করায়, শিক্ষাই বিপ্লব ঘটায়।


#সন্দিহান_মনুষ্যত্ব

দার্শনিক দেকার্ত এর মতে, "ইন্দ্রীয় যেহেতু ভ্রম দ্বারা বিভ্রান্ত হতে পারে, সেহেতু ইন্দ্রীয়ও সন্দেহের ঊর্ধে নয়, সেহেতু যুক্তি দিয়ে সত্যান্বেষণ করতে চাইলে বাস্তবতা সম্পর্কে যে কোন বিশ্বাসকেই সন্দেহ করতে হবে। "

আবার সক্রেটিস বলেছেন, "দুনিয়াকে জানার আগে নিজেকে জানতে হবে যার এক মাত্র মাধ্যম হল যৌক্তিক চিন্তা ভাবনা, মানুষের দুটো অংশ থাকে যার প্রথমটি - দেহ্ ও দ্বিতীয়টি আত্মা, আত্মায় আবার দুটো অংশ থাকে, এক হচ্ছে অযৌক্তিকতা যা আমাদের আবেগ দ্বারা গঠিত, অপরটি হচ্ছে যৌক্তিকতা যা আমাদের প্রকৃত রূপ, যৌক্তিকতা আমাদের মানসিকতার মানদণ্ড যেখানে প্রশ্ন উঠে প্রকৃত মানুষের সঙ্গা কি হতে পারে এবং আমাদের মানসিকতা সত্যিই মানুষের প্রকৃত সঙ্গায় অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছে কি না?

বিবর্তন হওয়া প্রাণীকুলে শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করার মাধ্যমই মানসিকতা, এই মানসিকতা আমরা যার মাঝে দেখতে পাই তাকেই মহা বিজ্ঞ ও প্রকৃত মানুষ হিসেবে জ্ঞ্যানে বোধ করি, অনুসরণ করি, কারণ আমরা সবাই প্রকৃত মানুষ হতে চাই।

মানুষ হওয়া যায় না, মানসিকতা চর্চা করতে হয়, যে যতদিন এই চর্চা করবে সে ততদিন মানুষ হিসেবে আখ্যা পাবে, যখন ভঙ্গ করবে তখন নিন্দিত হবে অমানুষ হিসেবে, সত্যকে সত্য বলা আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলার শিক্ষা আমরা তখনই পাব যখন বাস্তবতা সম্পর্কে সকল বিশ্বাসকেই আমরা সন্দেহ করতে পারব, যখন মানসিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারব সত্যের সন্ধানে।



প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে, সংস্কৃতি বিনা কখনো সম্প্রদায় গড়ে উঠে না , প্রতিটি সংস্কৃতি বিবর্তনের ছোঁয়ায় বিবর্তিত হতে হতে সভ্য হয়ে উঠে , পরিশেষে সভ্য হয়ে উঠা উৎকৃষ্ট সংস্কৃতিটুকু অবশ্যই সুন্দরের রুচিবোধ জাগাবে।

প্রতিটি সংস্কৃতিকে যার যার যায়গা থেকেই বোধে ধারণ করা উচিত, প্রতিটি সংস্কৃতি এক একটি দর্শন, এক একটি দৃষ্টিকোণ , এক একটি ভাবনার সমাহার।

কিন্তু যারা অপর সংস্কৃতিকে অপ বলে জ্ঞ্যান করে তারা সংস্কৃতির বোধ থেকে সাম্প্রদায়িক নয় বরং এরাই অধার্মিক, এরাই বাতাসে ছড়ায় ঈর্ষা আর অপ-সংস্কৃতির বীজ যা ভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে সম্প্রীতি অপেক্ষা বিদ্বেষ বেশি জাগায়।


আমাদের একটি সোনালী সময় ছিল, সুন্দর সংস্কৃতি ছিল, ছিল ভৈরবীর মতো বোধ , যে বোধ লিঙ্গভেদে ভাবতে শেখায়, ছিল গীতা যে রাগের চর্চার আঁচ মেলে নোবেল বিজিত ' গীতাঞ্জলি ' তে, ছিল এমন একটি শিক্ষা যা সকল প্রাণে বা বস্তুতে নিজেকে সমর্পণ করতে শেখায়, যে দৃষ্টি নগ্নতায় কখনো যৌনতা আবিষ্কার করেনি, এমন একটি পরিবার যেখানে যৌথ বন্ধন বজায় থাকত অটুট বংশপরিক্রমায়।

অথচ এ সংস্কৃতি , এ সুর, এ চর্চা এ অঞ্চলেরই, বাংলার বায়ুপ্রবাহে আমি শঙ্খসুর শুনতে পাই যে কণ্ঠ আমার আদিপুরুষের, এ মাটিতে আমি রক্তের ঘ্রাণ পাই যা আমারই আদি পুরুষদের যারা ধার্মিক ছিলেন, যারা ধর্মান্তরিত না হওয়ার অভিযোগে খুন হয়েছিলেন এ মাটিতেই, আর এই সমস্ত খুনের উপরই তিলে তিলে গড়ে উঠেছে আজকের নব্য সভ্য বৈশ্বিক সংস্কৃতি।

সংস্কৃতির এই পরিবর্তনের মাধ্যমে যেমন আমরা একটা নব্য সভ্যতা পেয়েছি, এরই সাথে হাড়িয়ে ফেলেছি অনেক সভ্যতা ও তাদের সংস্কৃতি, তাদের সংখ্যার পরিধিটুকুও ছোট নয়।


#দৃষ্টিতে_প্রাণের_প্রভাব 

আমি যা দেখছি, তা আদৌ সত্য নয়, তা কেবলই আমার মনের ধারণা মাত্র।প্রকৃতির যে সকল রূপ, রং ও গন্ধে আমার মন মেতে উঠে তা শুধু মাত্র আমার মস্তিষ্কের কল্পনা।

প্রকৃতিতে রং নেই, নেই স্বীয় রূপ ,গন্ধ বা প্রাণ, আছে শুধু বস্তু জগতের উপাদান।

আমার মনই কেবল জড় আর জীবদের আলাদা করছে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে, নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম, কিছু তফাৎ।


প্রাথমিক চিন্তনে আমরা গাছেদের জড় বলে ভেবেছিলাম, পরবর্তীতে আবিষ্কৃত হল গাছেদেরও প্রাণ আছে এবং এরা নির্জীব নয় , তাদেরও আছে জন্ম মৃত্যুর চক্রাকার নিয়ম, নিয়তি ও পরিনতি।

এরাও জন্মায়, বড় হয়, এদেরও আছে শৈশব, কৈশোর , যৌবন ও বৃদ্ধকাল

বৃক্ষ মাতৃকার যোনীপথকে আমরা ফুল বলে ডাকি এবং ডিম্বাশয়কে বলি মুকুল আর ডিম্বকে চিনি ফল রূপে।


#জীবনের_উদ্দেশ্য 

পিতামাতার জীবনের শ্বাসত উদ্দেশ্য যেমন হয় সন্তানদের আদর্শ হিসেবে গড়ে তুলা , এরই মাঝে মানুষের সন্তানেরা সব সময় আদর্শ ওপেক্ষা অসৎ হয়ে উঠে কারণ মানব পিতা মাতারা তাদের সন্তানদের আদর্শ হিসেবে গড়ে তুলা অপেক্ষা 'টিকে থাকার প্রতিযোগিতায়' ব্যস্ত থাকেন বেশি , যে কারণে মানুষ তার সন্তানদের উপর পুরো মনোযোগ দিতে ব্যর্থ, কিন্তু গাছেদের জীবন ও বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যই কেবল তার সন্তানদের আদর্শ হিসেবে গড়ে তুলা, যে কারণে গাছেদের জাতগত পরিচয় আপন ফল সম্পূর্ণভাবে বহনে সক্ষম।


বঙ্কিমের ধারণা মতে, গাছেদের কেবল তার সন্তানদের আদর্শ রূপে গড়ে তুলা অপেক্ষা ভিন্ন কোনো কাজ নেই, তাদের জীবনের শ্বাসত ও অনন্ত উদ্দেশ্যই যেনো সন্তানদের আদর্শ রূপে গড়ে তুলা - এ যেনো ঈশ্বরের ইচ্ছা বা ঐশ্বরিক নির্দেশনা যা গাছেরা পালনে বাধ্য।

বঙ্কিম হয়ত এরই মাধ্যমে অস্বীকার করছেন গাছেদের স্বীয় ইচ্ছাশক্তির প্রভাব, প্রকৃতির যোজন বিয়োজনে কতটা অটুট বৃক্ষরাজি, পরিবেশে তাদের ব্যক্তিত্বের প্রভাব ইত্যাদি।


প্রকৃতির প্রয়োজনে ভারসাম্য বজায়ে গাছেরা কখনোবা নিজের পাতাদের ঝড়িয়ে ফেলে, আগত মুকুলদের কিছু অংশকে বিনষ্ট করে, গাঁয়ে এঁটে থাকা বাকল গুলিকে খসিয়ে দেয়, অতঃপর নব রূপে প্রকৃতিকে সাজিয়ে তুলে নতুন মৌসুমের নামে।

মানুষের নির্বিচারে বৃক্ষ কর্তনে, বৃক্ষেরা সংগঠিত করে নীরব বিপ্লব, যা অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়ে প্রকৃতিতে এনে দেয় মহামারী, বিপর্যয় এবং তখনই প্রকৃতি মানুষের সমাজে চালায় ত্রাসের রাজত্ব।


#নিষ্প্রাণে_প্রাণের_সঞ্চার 

গাছপালা, ইট, পাথর, মাটি, বায়ু বা আগুণ, অচেতন মননে সবই জড়, আবার মনের চৈনত্যে যেনো এরা সবাই প্রাণ।

"শৈল্পিক মন নিষ্প্রাণে করে দান, নব প্রাণ" - এটি একটি ডাইমেনশন বা দেখার মাত্রা। যে দৃষ্টিকোণ স্থান পেয়েছে 'তৃতীয় চোখ বা দিব্যদৃষ্টি' শব্দ সমূহে।

নিষ্প্রাণ শব্দগুচ্ছ একত্রে পরপর সাজালে জ্বালাময়ী বক্তৃতা তৈরী হয় যা একটা জাতিকে ঘুরে দাঁড়াতে শেখায়, সংগঠিত করে সফল বিপ্লব,  প্রতিবাদের ভাষায় শক্তি সঞ্চার করে, তীক্ষ্ণ করে বিচক্ষণতা, অতঃপর প্রাঞ্জলতার প্রতিকী সরূপ প্রকাশ পায় লেখাটি, এ যেন একটি লেখা তথা সাহিত্যের প্রাণ যা সৃষ্টি হয় কোনো শৈল্পিক লেখকের চিন্তনে, এ প্রাণ শক্তি সঞ্চার করে শৈল্পিক পাঠকের মননে।

আর, অচেতন পাঠক কিংবা অসার লেখকের কাছে এ পাঠ্য কেবলই নিরর্থক, মৃত ও অচল, অতঃপর তাদের কাছে লেখাটি নিষ্প্রাণ।



Comments

Popular Posts